সৈয়দ কওসর জামাল

রাসিতে গদ্যকবিতাকে বলা হয়েছে poème en prose; আর এই কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্যভালিয়ের দ্য জোকুর লিখেছেন :

“একটি কাজের ধারা (jenre d’ouvrage) যেখানে আমরা পাই কাব্যের এক উদ্ভাবন ও শৈলী (l’on retrouve la fiction et le style), যার সাহায্যে মিল ও মাপ ছাড়াই তারা সত্যিকার কবিতা হয়ে ওঠে। গদ্যকবিতার কাছে আমাদের ঋণ তার নিরীক্ষার জন্য, যা একসঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য ও বিস্ময়কর এবং সেই সঙ্গে নীতি হিসেবে যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবোপযোগী, আর সেসব কখনই দিনের আলো দেখত না যদি না তাঁদের লেখকেরা উদ্ভাবনকে অন্ত্যমিল ও মাপজোকের মধ্যে ফেলে রাখতেন। পদ্য ছাড়াই এত সুন্দর কবিতা আছে, যেভাবে গাঢ় রঙের ব্যবহার ছাড়াই আমাদের অনেক ছবি তৈরি হয়েছে।”

(Encyclopédie, ou Dictionnaire raisonné des sciences, des arts et des métiers, ১৯৬৭)

এ দেশে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকেও বলতে শুনেছি কাব্য শুধু পদ্যেই নয় গদ্যেও লিখিত হতে পারে। আমেরিকান কবি হুইটম্যানের কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ গদ্যকবিতা বলে মনে করেছেন—“আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে গদ্যে কাব্যরচনা করেছেন ওয়াল্ট হুইটম্যান। সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তার প্রভেদ নেই তবে ভাবের দিক থেকে তাকে কাব্য না বলে জো নেই।” রবীন্দ্রনাথ নিজেও গদ্যকবিতার নিরীক্ষা করেছেন। লিপিকা-র প্রথম দিকের কিছু কবিতা তিনই গদ্যে লিখেছেন। তাঁ র ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’কবিতাটিকে গদ্যকবিতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে—“এখানে নামল সন্ধ্যা। সূর্যদেব কোন দেশে, কোন সমুদ্রপারে, তোমার প্রভাত হল…।” শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির যে কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলো ছিল গদ্যেই, কিন্তু তাঁদের কাব্যগুণের জন্য ইংরেজ তথা বিশ্বের কবিতাপাঠকের কাছে কবিতার মর্যাদাই পেয়েছে। বাংলা  গদ্যকবিতাকে যিনি সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছেন তাঁরা হলেন সমর সেন ও অরুণ মিত্র। প্রথম দিকে অরুণ মিত্র ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ফরাসি কবিতার সংস্পর্শে আসার পর তিনি গদ্যকবিতা ছাড়া আর কিছু রচনা করেননি।  

ফরাসি গদ্যকবিতার সূচনাকারী হিসেবে অনেকেই আলোয়াসিয়্যুস বেরত্র্যাঁর নাম উল্লেখ করে থাকেন। তাঁর গদ্যকবিতার সংকলন Gaspard de la nuit (১৮৭২) গদ্যে রচিত। এই কবিটায় বেরত্র্যাঁ গদ্য ও পদ্যের সীমানা উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনও বলা হয়ে থাকে যে যে গদ্যকবিতা আমরা পাই বোদল্যের ও মালার্মের কাছ থেকে, তার সূত্রপাত বেরত্র্যাঁর হাতে। অর্থাৎ, গদ্যকবিতার শুরু উনিশ শতকের রোম্যান্টিকতার যুগে, এবং রোম্যান্টিকতার হাত ধরেই লিরিক্যাল কাব্য-প্রকাশের নতুন পথ নির্মিত হয়েছে গদ্যকবিতার মাধ্যমে। এই কাব্যমুক্তি রোম্যান্টিকতারই অবদান। আর বোদল্যের এই নতুন ধারাকে বাস্তবায়িত করেছেন উনিশ শতকের প্যারিসের প্রতি তাঁর ‘স্প্লিন’ বা বিষণ্ণ মনোভাবকে ‘petits poemes en prose’-এ রূপান্তরিত করে।

কবিতার ইতিহাসকারেরা অবশ্য এই ধারার উৎস খুঁজতে কোনও সময়সীমা নির্ধারণ করতে চাননি। সপ্তদশ শতকের শেষে রচিত গদ্য  Livre du promeneur থেকে  Les Aventures de Tèlèmanaque (১৬৯৯) কিংবা রোম্যান্টিক কবি শাতোব্রিয়াঁ থেকে বাইবেল সর্বত্রই গদ্যকবিতার সন্ধান করেছেন তাঁরা। ফেনেলঁ-র ‘তেলেমানাক’ গদ্যে কবিতা হয়ে ওঠার পরিবর্তে হয়েছে গদ্যে লেখা মহাকাব্য।  আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত যখন বোদল্যের-এর ‘petits poems en prose’ গদ্যকবিতার আধুনিক রূপটিকে উন্মোচিত করছেন। 

আদর্শ হিসেবে বোদল্যের গ্রহণ করেছিলেন আলোয়াসিয়্যুস বেরত্র্যাঁর Gaspard de la nuit-কে। খুব সচেতনভাবে রচিত এই গদ্যে প্রগাঢ়ভাবে ব্যবহার করা হল কাব্যের সমস্ত প্রকরণকে। দৈনন্দিন জীবনের বিভীষিকা ও আনন্দকে কাব্যে ধরে রাখতে চেয়েছেন বোদল্যের। অতীতের দিকে না তাকিয়ে তিনি চোখ রেখেছেন বর্তমানের দিকে। তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে মিশে আছে সংগীত। তাঁর দৃষ্টি বাস্তবের আন্তরিক প্রকাশে। নাগরিক অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা দৃশ্য, দৃশ্যকল্প ও ধ্বনি আহরিত হয় তাঁর গদ্যকবিতায়। আর এভাবেই তৈরি হয়ে যায় তাঁর নিজস্ব রচনাশৈলী। 

বোদল্যের-এর এই গদ্যকবিতাগুলো সংকলিত হয়ে আছে তাঁর Le Spleen de Paris  কাব্যগ্রন্থে। কবি স্বীকার করেছেন যে এই কবিতাগুলোয় তিনি ‘গাসপার দ্য লা ন্যুই’কে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হবে আধুনিক জীবনের বর্ণনার প্রেক্ষিতে। তিনি রচনা করতে চেয়েছেন গদ্যকবিতার অলৌকিক স্বপ্নকে, ছন্দ ও মিলহীন সংগীতকে, যাতে মনের লিরিক্যাল প্রবণতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে। আর বিষয় করেছেন প্যারিসের রাস্তার জীবন। ফলত এই কবিতাগুলোর বাস্তবিক কোনো অনুসরণের ঋণ নেই পূর্বসূরীর কাছে। বরং গদ্যকবিতায় বোদল্যেরই পরবর্তী কবিদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছেন।

  Le Spleen de Paris এর কাব্যকথা তৈরি হয়েছে কমিউনিটি ও পরিবারের অস্থির সন্ধানে, আর শুরুতেই বাস্তব ও ফ্যান্টাসির বিবাদ;  আর এর ফলে অর্থহীনতা ও অবসাদের কাছে আত্মসমর্পণ। এই ধরনের গদ্যকবিতায় অধিকন্তু আছে কথোপকথনজাত ঐক্য, অষ্পষ্টতা, ক্রোধ ও ঔদার্য, দিবাস্বপ্ন ও আত্মদর্শন। কথোপকথনের সূত্রে পাঠককেও যুক্ত করা হয়েছে, যেমন প্রথম কবিতা ‘অপরিচিত’ (l’Estranger) কবিতায় দুই ভিন্ন শ্রেণির দুই মানুষের সংযোগহীনতার কথা :

‘আমাকে বলো, দুর্জ্ঞেয় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো ? তোমার বাবা, তোমার মা,

তোমার বোন, কিংবা তোমার ভাইকে?’

‘আমার বাবা নেই, মা নেই, কিংবা বোন বা ভাই।‘

‘তোমার বন্ধুরা?’

‘তুমি যে শব্দটি উচ্চারণ করলে এখনই যার অর্থ এখন পর্যন্ত অজানা আমার কাছে।‘

‘তোমার পিতৃভূমি?’

‘আমি জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।‘

‘সৌন্দর্য?’

‘আমি স্বেচ্ছায় ভালোবাসব তাঁকে, দেবী ও চিরজীবীকে।‘

‘সোনা?’

‘আমি তা ঘৃণা করি যেমন ঘৃণা তুমি ঈশ্বরকে করো।‘

তাহলে! কী ভালোবাসো তুমি, অদ্ভুত অচেনা মানুষ?’

‘আমি ভালোবাসি মেঘ…চলমান মেঘ…ওইখানে…ওইদিকে…আশ্চর্য মেঘগুলো!’

এই কবিতা ফরাসি ভাষায় আগে লেখা হয়নি যেখানে গদ্য য় পদ্যের বেড়া ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং এক আপাত জটিল আখ্যান ও ভাষার ছকে পাঠকের প্রতিক্রিয়া আহ্বান করা হয়েছে। ফরাসি কবিতার পাঠক তার কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কারণ এখানে প্রচলিত কাব্যকাঠামো নেই। যা আছে তা এক কাব্য-ডিসকোর্স মাত্র।

বোদল্যের-উত্তর ফরাসি কবিতায় poème en prose জনপ্রিয় হয়েছে এ কথা বলা যায়, কারণ অনেক কবিই গদ্যকবিতা লিখতে এগিয়ে এসেছিলেন। এই কবিতা এনে দিয়েছে তাদের মুক্তির স্বাদ—মুক্তি আলেক্সান্দ্রাইন কাঠামো ও বারো মাত্রার অত্যাচার থেকে। 

বোদল্যের-এর ভাবশিষ্য আর্ত্যুর র‍্যাঁবো গদ্যকবিতায় তাঁকে অনুসরণ করেছেন। ‘ইল্যুমিনাসিয়ঁ (L’Illuminations) কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই গদ্যে রচিত।  চল্লিশটি কবিতার সিরিজ – নতুন কাব্যভাষা ও কাব্যিক গঠনের দিক থেকে এ হল তাঁর নবনিরীক্ষা। তিনি তৈরি করলেন এক কল্পনার জগৎ, যে জগতের আছে নিজস্ব পুরাণকথা, প্রায় স্বর্গীয় মানুষজন, নিজস্ব শহর – সব বর্ণিত হচ্ছে বিচিত্র চলচ্ছবির মতো রূপকল্পের মধ্যে দিয়ে। এই কাঠামোর মধ্যে র‍্যাঁবোর জীবনের বিভিন্ন পর্বের নাটকীয়তাকে ধরা হয়েছে। নিজেকে কবি স্বপ্ননির্মাণ করতে দেখছেন। যন্ত্রণার দুঃস্বপ্নগুলোকে পুনর্জীবিত করা হচ্ছে চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে। এই কবিতাগুলোয় র‍্যাঁবো পৌঁছেছেন তার স্বকীয়তার শীর্ষবিন্দুতে। ভাষা গূঢ় স্টাইলের পক্ষে সাযুজ্যপূর্ণ। গদ্যকবিতাকে তিনি মুক্ত করেছেন কাহিনিধর্মিতা, বর্ণনা ও বিষয় থেকে। এই কবিতাগুলোই পরবর্তী ফরাসি কবিতাকে প্রভাবিত করেছে ধরাবাঁধা আঙ্গিক থেকে বেরিয়ে আসতে। একটি খুব ছোটো কবিতা-– ‘ফেত দিভের’, শীতের উত্সব :

“কমিক অপেরার কুটিরগুলোর পিছনেই জলপ্রপাতের শব্দ। ঝাড়লণ্ঠনগুলো এগিয়েছে সংলগ্ন ফলের বাগান ও সর্পিল পথগুলোর দিকে,–সূর্যাস্তের সবুজ ও লাল রঙের মধ্যে দিয়ে। হোরেসের জলপরীদের মস্তকাবরণ প্রথম সাম্রাজ্যের,– সাইবেরীয় নাচ, বুশারের চিনা রমণীরা।“

বোদল্যেরকে অনুসরণ করে কথোপকথনের ভঙ্গিটিও ব্যবহার করছেন র‍্যাঁবো :

“একদিন সকালে, শান্তশিষ্ট লোকজনের এক দেশে, এক সুপুরুষ ও এক সুন্দরী নারী উন্মুক্ত পার্কে চিৎকার করে বলে, ‘বন্ধুরা, আমি এই নারীকে রানি হিসেবে দেখতে চাই।‘ ‘আমি রানি হতে চাই’। নারীটি হাসে ও কেঁপে ওঠে। পুরুষটি বন্ধুদের জানায় তাদের শেষ হওয়া এক বিচারের কথা। তারা একে অপরের ওপর পড়ে মূর্ছা যায়।

আসলে সারা সকালটা ধরে তারা ছিল রাজারানি যখন অলক্ত বর্ণের পোশাক গৃহগুলো থেকে ঝুলছিল, আর যখন সারা বিকেল ধরে তারা পাম বাগানের দিকে হাঁটছিল।“

(Royauté/রাজমর্যাদা)

শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা যাতে আকাঙ্ক্ষিত সৌকর্যে পৌঁছোতে পারে কবিতাটি তার প্রয়াস আমরা র‍্যাঁবোর মধ্যেও লক্ষ করছি। অন্যদিকে, মালার্মের গদ্যকবিতায় পাই নিজেকে প্রশ্ন করার রীতি। বোদলেরীয় শিল্প-সচেতনতাও তার মধ্যে আছে। ‘সাদা ওয়াটারলিলি’ কবিতায় দেখি—

“অনেকক্ষণ ধরে আমি দাঁড় টানছি, দ্রুত লম্বা লম্বা সমানতালে দাঁড়ের প্রক্ষেপ, অন্তর্মুখী চোখদুটো দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে আত্মবিস্মরণের গতিতে, কারণ চারদিকে ভেঙে পড়ছে হাসি। এত বেশি স্থবিরতা সাহায্য করছিল আমাকে এই সময় কাটাতে যে যখন হঠাৎ জেগেছি য়ামার নৌকোর এক বিদ্ঘুটে শব্দে, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমি থেমেছিলাম উঠে থাকা বৈঠার ওপর স্পষ্ট নামের উজ্জ্বলতায়; আর তখনই আমাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বাস্তবের পৃথিবীতে।”

প্রায় সব কবিতাই গদ্যে লিখেছেন অঁরি মিশো। চতুর চরিত্রও তৈরি করেছেন একটা গল্প বলার জন্য।‘জেটি’ নামের কবিতাটির এক অংশ দেখা যাক—

“যে মাসগুলোতে আমি অঁফ্লরে থাকছিলাম, তখন পর্যন্ত আমার সমুদ্রের ধারে যাওয়া হয়নি, এর কারণ আমাকে গৃহবন্দি থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার।

কিন্তু গতরাতে, একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত আমি চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন থাকার সুযোগে সমুদ্রের মতো দূরত্বেই নির্মাণ করেছি একটা জেটি। তারপর তার ঠিক ডানদিকে, পা ঝুলিয়ে আমি তাকিয়ে থেকেছি নীচে, সমুদ্রের দিকে, সে তখন খুব গভীর শ্বাস নিচ্ছিল।

ডানদিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ আসে।

আমার মতোই পা ছড়িয়ে সমুদ্র দেখছিল একটা লোক। “এখন আমার বয়স হয়েছে”, সে বলে, “এত বছর ধরে যা কিছু জমা রেখেছি এইবার সব তুলে নিতে হবে।”

এবার সে পুলির দড়ি টানতে থাকে।”

উল্লেখযোগ্য প্রায় সব কবিই কিছু না কিছু গদ্যকবিতা লিখেছেন। মাক্স জাকব, এল্যুয়ার, স্যাঁ-জন পের্স, ফ্রাঁসিস পোঁজ এই ধারাকে প্রসারিত ও বৈচিত্রপূর্ণ করেছেন। ফরাসি কবিতার অনুসরণেই বাংলায় গদ্য কবিতার চল শুরু করেন অরুণ মিত্র। এখন অনেক কবিই গদ্যে লেখেন। সে এক স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয় হতে পারে।

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started