পার্থজিৎ চন্দ

রতের রাত্রি, সদ্য পাঠ শেষ হয়েছে জন ম্যাকার্থি ও প্যাট্রিক হেইস-এর লেখা গম্ভীর গদ্য- Some Philosophiocal Problems from the Standpoint of Artificial Intelligence। প্রথম দিকে লেখকদ্বয় কয়েকটি প্রশ্ন উসকে দিয়েছেন, তারপর তাঁরা জটিল সব ইকুয়েশনের সাহায্যে সেগুলিকে ভাঙতে ভাঙতে ও প্রতিষ্ঠা করতে করতে গেছেন। 

এখানেই পেয়েছিলাম চিন্তাভাবনার জগৎ ওলটপালট করে দেওয়া একটি পর্বের শিরোনাম – Why artificial intelligence needs philosophy। যে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ‘কৃত্রিম’ শব্দটি যুক্ত হয়ে রয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে তারও ক্রিয়া করবার জন্য প্রয়োজন দর্শনের! 

এই মারাত্মক ও ঘাতক ধারণাটির কাছে ধূসর বেড়ালের মতো ঘুরে ঘুরে যে কোনও মানুষের জীবন কেটে যেতে পারে। দর্শন শব্দটির মধ্যে এখানে নিশ্চয় লুকিয়ে রয়েছে সজল-মেঘের ছায়া, প্রাণের গূঢ় প্রশ্ন যে পথে বারবার ধেয়ে চলেছে ‘উত্তর’-এর দিকে তার ইশারা। এখন প্রশ্ন ঘুরেফিরে সেই একটি জায়গাতে এসে থরথর করে কাঁপতে থাকে – যা কৃত্রিম এবং যা তার কৃত্রিমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত (?) নয় তারও কেন প্রয়োজন হয়ে পড়বে ‘দর্শন’-এর মতো প্রাণের এমন জলজ্যান্ত জয়-তিলক? আর একবার সেই সেই জয়-তিলকের সন্ধান পাবার পর তাকে কি আর ‘কৃত্রিম’ হিসাবে গণ্য করা যাবে?

এর পরের প্রশ্নটি এমন হতে বাধ্য – তা হলে কি ‘কৃত্রিম-অকৃত্রিম’ বলে পৃথক দুটি বিষয় আসলে অবস্থান’ই করে না! শুধু যে সিস্টেম এই ‘দর্শন’টির খোঁজ পায়নি এখনও তাকেই আমরা কৃত্রিম হিসাবে গণ্য করে নিই? এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সে ‘খোঁজ’ বা ‘কোয়েস্ট’টিই খেলা করে চলেছে সমস্ত রূপের মধ্যে? 

ম্যাকার্থি ও হেইস-এর লেখা গদ্যটির শিরোনামে আরেকটি ভয়ংকর ছদ্মবেশী শব্দ লুকিয়ে রয়েছে, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়বার পাঠ করার সময়ে হয়তো তাকে চোখে পড়ে না, সে তার ছদ্মবেশ খোলে না আমাদের কাছে। কিন্তু ধীরে, অতি ধীরে আমাদের মাথার ভেতর ঘুরতে শুরু করে সেই শব্দ – Needs।

যখনই লেখক’রা ‘নিডস’ (প্রয়োজন) শব্দটিকে ব্যবহার করলেন তখনই ঘন কুয়াশা আরও চেপে ধরল; নিডস একটি জোরালো শব্দ, কোয়েস্ট-এর বিষয়টি আরও তীব্র হল। এই কোয়েস্টের শেষ কোথায়? শেষ বলে আদৌ কি কিছু আছে? না কি শেষ বলে যাকে মনে হচ্ছে তা আসলে শেষের শুরু মাত্র?

রবীন্দ্রসংগীতের অসীম আকাশ; শরতের ভেসে যাওয়া মেঘ ও গূঢ় এক কী যেন খুঁজে চলার কাছে ফুটে উঠতে শুরু করেছিল সেই গান, ‘অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ / কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালায়ে – / তুমি কোথায়, তুমি কোথায়?।’

আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ছায়াপথের কিছুটা নীচ দিয়ে হু হু করে বয়ে চলেছে এই কোয়েস্ট। মূলত এই কোয়েস্ট’টিই বস্তু, এই কোয়েস্ট’টিই ধারণা – এই কোয়েস্টের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মূর্ত-বিমূর্ত। যাবতীয় কংক্রিট-অ্যবস্ট্রাক্ট, শূন্য ও পূর্ণের মধ্যে এই বিষয়টিই খেলা করে চলেছে। আরও উন্মোচন করলে বলা যায়, এই কোয়েস্ট’টি ছাড়া আর কিছুই নেই। 

এই কোয়েস্ট কোনও আলোর সন্ধান নয়; কোনও অন্ধকারের জরায়ুর মধ্যে জন্ম নেওয়া অন্ধকার নয়। আলো-অন্ধকারের চির-পরিচিত ধারণা পেরিয়ে এই কোয়েস্ট ‘চিরপ্রশ্ন’।

গানটির প্রথম তিনটি পঙক্তি’র মধ্যেই স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়ে যায়, আকাশ অসীম; গ্রহ-উপগ্রহ অগণন। কী আশ্চর্য, ‘তুমি কোথায়, তুমি কোথায়’ অংশটি পড়বার পর আমার মনে হতে শুরু করে আকাশজোড়া কত ‘তপন’ তাদের আলো হারিয়ে ফেলছে একটু একটু করে, ধীরে ধীরে  ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। 

তৃতীয় ও চতুর্থ পঙক্তির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি বিরতি, যেন এক মহাসত্যের আবরণ উন্মোচন করবার আগে সামান্য প্রস্তুতি গ্রহণের অবকাশ। 

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হায় সকলই অন্ধকার – চন্দ্র, সূর্য, সকল কিরণ, / আঁধার নিখিল বিশ্বজগত’।

এখানে এসে গানটির মধ্যে দ্বিতীয় মাত্রা নিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে সেই কোয়েস্ট – তা হলে কি সেই ‘তুমি’র অনুপস্থিতির কারণে ‘আঁধার নিখিল বিশ্বজগত?’

পরের পঙক্তি’তে আরেকবার ভিন্ন একটি স্তরে উড়াল দেয় গানটি, বাইরের ‘তুমি’ থেকে অন্তরের তুমির দিকে ঢলে পড়তে শুরু করে সেটি। যে মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘তোমার প্রকাশ হৃদয়মাঝে সুন্দর মোর নাথ -/ মধুর প্রেম-আলোকে তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে।।’ সে মুহূর্তে খুলে গেল একটা দরজা। অভ্যাসবশে এটিকে আলোর দরজা বলে উল্লেখ করতে ইচ্ছা করলেও তা সংবরণ করতে হবে…হবেই। কারণ বারবার আলোর ইশারা ও উল্লেখ থাকলেও রবীন্দ্রনাথ নিছক ‘আলো’ অর্থে ‘আলোক’ শব্দটি ব্যবহার করেননি বলেই মনে হয়। প্রথম তিন-পঙক্তি’তে তিনি আলো জ্বেলে ঘুরে চলা তারকারাজির কথা বলেছেন, অথচ পরের দুই-পঙক্তি’তে এসে তিনি চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি সবই অন্ধকারে নিমজ্জিত বলে উল্লেখ করছেন। 

আবার একটি ব্যাস-কূট জন্ম নিচ্ছে এখান থেকে। শরতের রাত্রে এই ব্যাস-কূটের কাছে বসে থাকতে হয়, নির্জনে; একা একা। বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ আসলে প্রথম তিনটি-পঙক্তি’তে আলোর কথা বলেনই’নি। বিচিত্র আলো জ্বেলে ঘুর বেড়ানো চাঁদ-সূর্য-তারার বাহ্যিক আলোকে নির্দেশ করে দেখাতে চেয়েছেন যে সে আলো আসলে প্রতারক। প্রতারক বলেই ‘বিচিত্র’। 

‘বিচিত্র’ শব্দটি যতই মৃদু ও রবীন্দ্রনাথ-সংলগ্ন লাগুক না কেন আমাদের মনে রাখতে হবে সে আলো বিচিত্র বলেই ‘একক’-এর থেকে বিচ্ছিন্ন। 

আরেকটি সম্ভাবনাও উপেক্ষা করা যায় না – হয়তো চাঁদ-সূর্য-তারার দল ক্রমাগত ‘শেষের’ পরের প্রশ্নটির দিকে ছুটে চলেছে। যে ‘তুমি’র জন্য এই হাহাকার, সে নিজেই তৈরি করে চলে এই প্রশ্ন বা বলা যেতে পারে এই প্রশ্ন তৈরি হবার ফলে যে ‘কোয়েস্ট’ সেখানেই এই ‘তুমি’র অধিষ্ঠান। যদিও এখানে একটি এপিমেনেডিস প্যারাডক্স সৃষ্টি হবে; প্রশ্ন উঠবেই – কে কাকে জন্ম দিয়ে চলেছে? 

সৃষ্টি কি প্যারাডক্সিক্যাল? সে দূর্জ্ঞেয়? না, অজানা? রবীন্দ্রনাথের গানের সব থেকে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই প্রশ্নটি। কারণ রবীন্দ্রনাথ প্যারাডক্স-কে চিহ্নিত করেছেন। উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছেন তার রূপ; এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, তিনি লিখছেন, ‘তোমার প্রকাশ হৃদয়মাঝে সুন্দর মোর নাথ -/ মধুর প্রেম-আলোকে তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে।।’ রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর ‘নাথ’ ও প্রেম’কে আশ্রয় করে এই প্যারাডক্স’কে অতিক্রম করে যান, কিন্তু আমাদের জন্য রেখে যান অতিক্রম করে যাওয়া জগত ও প্যারাডক্স – দু’টিকেই।

এ ‘তুমি’র আভরণ একমাত্র মধুর প্রেম। কিন্তু তিনি কি শরতের রাত্রে আমাদের শুধু এখানেই ছেড়ে রেখে চলে যাবেন? যাবেন না, এবং যাবেন না বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ। 

এবার আরেকটি অকল্পনীয় উল্লম্ফন, ‘…তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে।।’

আপাতভাবে দেখতে গেলে এই চারটি শব্দের মধ্যে কোনও ‘প্যাঁচ’ নেই। কিন্তু এবার ধীরে ধীরে আপনাকে আক্রমণ করবে প্রকাশ-মাধ্যমজনিত চিন্তাভাবনা। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন ‘তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে’, অর্থাৎ ‘তার’ প্রকাশই একমাত্র সত্য। যে সত্তা ‘হৃদয়’কে ধারণ করে রয়েছে, গানটি বারবার পড়ার পর, তার উপস্থিতি ও ভূমিকা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। ‘মাধুরী’ প্রকাশে তার ভূমিকা কতটুকু? যেন বনের মধ্যে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে পুরানো রেডিও এবং তারই সঙ্গে তীব্র হয়ে উঠছে সুন্দর, সুর, আলো। 

‘সুন্দর’ কি স্বয়ং-প্রকাশিত? না কি সত্তার ভূমিকা থেকে যায় এক্ষেত্রে?

অথবা বৃদ্ধ-প্যাঁচার মতো খুঁজে আনা যাক সে প্রশ্নও – সত্তা কি সেই আলোর স্পর্শ পাবার আগে সুন্দর’কে চিনে নিতে সক্ষম? না কি এই আলোর স্পর্শই ‘সুন্দর’?

প্রশ্নের শেষ কোথায়? নেই, নেই এবং নেই; কারণ সত্তা তা হলে কোন পথ ধরে ‘আঁধার নিখিল বিশ্বজগত’কে চিনে নেয়? আলোর স্পর্শ পাবার আগে সত্তার আলো-অন্ধকারের বোধ যে বিদ্যমান, সেটিকে স্বীকার না-করা ছাড়া উপায় থাকে না আর।

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started