অনিমেষ মণ্ডল

নীলে মাখামাখি এক বিহ্বল ঈশ্বরের মুখ

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা

সুগত, এ-জন্মে আমি কেউ না তোমার ।

আজ তবু সন্ধ্যায় যখন
জাতিস্মর জ্যোৎস্নার ঝালরে
তোমার হাসির মন্ত্র নীরব ঝর্ণায় ঝরে পড়ে,
আমারও নির্বেদ ঘিরে পূর্ণিমার তিলপর্ণিকার
অগুরু গন্ধের বৃষ্টি-মনে হল এখানে আবার
তোমার সময় থেকে বহুদূর শতাব্দীর তীরে
জয়শ্রীজীবন পাব ফিরে,
ফিরে পাব পরশরতন।
(বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে/যৌবনবাউল/1959)

এমনই অপরূপ সব উপলব্ধির পরশরতন তিনি রেখে গেলেন আমাদের জয়শ্রী জীবনের জন্য। সাতটি দশক ধরে তিনি বাংলা কবিতার এক অবিসংবাদী বাউল যার যৌবন অনন্তের।তাই তাঁর উচ্চারণে এক শাশ্বতকালের ধ্বনি বাজে যা আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতিকে বহন করে নিয়ে চলে। আমরা তা দেখতে পাই, ছুঁতে পারি, অনুভব করতে পারি আমাদের সমগ্র সত্তা দিয়ে। তাই তিনি অনন্য। এক প্রগাঢ় ভালোবাসার সামনে আমাদের নতমুখে দাঁড় করিয়ে রাখেন। আমরা উজ্জীবিত হই বাংলা ভাষায় লেখা রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ সব লিরিকের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে।

অথচ এখানে ছোটো পুকুরের পাড়ে
একটি প্রশান্ত হাঁস মাথা নাড়ে, যারে
ছুঁয়েছে জলের প্রেম বহুবার;আলোর চন্দন
মেখেছে অনেক, তবু তবু ওর নিরাসক্ত মন
যতোবার জল বাড়ে আলো তারে মিনতি জানায়
সবার গ্রাহক হয়ে স্থির আছে নিস্পৃহ ডানায়,
সারা মুখে লেগে আছে হাসি;
একটি হাঁসের রাজ্যে হব আমি প্রসন্নউদাসী।।
(একটি হাঁসের রাজ্য/যৌবনবাউল)

পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান এই কবি ঈশ্বর ও নিসর্গের ভিতর অবলীলায় ধারণ করেন প্রেম।এই প্রেম একদিকে যেমন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তেমনি অন্যদিকে এক বিপুল নিস্পৃহতায় ঝরে যেতে পারে হাঁসের গায়ে লেগে থাকা জলের মতো।একটা প্রার্থনার মৃদুমন্দ উচ্চারণ বেজে যায় অস্ফুটে অলোকরঞ্জনের কবিতায়। প্রবল নাস্তিকও সেখানে খুঁজে পান ঈশ্বরের ধারণা।তিনি বলেন …”একসময় মনে হয়েছিল ঈশ্বর নেই, একটা স্বপ্ন আছে ।”তিনি আবিশ্ব বাঙালির মনে সেই স্বপ্নটা বুনে দিতে চেয়েছেন।যেখানে ঈশ্বর আছেন কি নেই সেটা বড় প্রশ্ন নয়।প্রশ্ন হলো মেধার অর্জন কতটা গভীরে শিকড় বসাতে পারে।তাই তিনি বহন করেন উপনিষদ,বৈষ্ণবসাহিত্য, চর্যাপদ এবং ভারতীয় লোকপুরাণের উত্তরাধিকার।

তাঁর কবিতায় স্থান ও কালের ক্রমাগত প্রসার ঘটতে ঘটতে তা বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেছে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল শীর্ষে ।আমাদের দুখিনী বর্ণমালা পেয়েছে গৌরবের অধিকার।এক নতুন কাব্যভাষায় তিনি তুলেছেন রিনিরিনি ঝংকার।যা শুধু সৌন্দর্যই সৃষ্টি করেনি ভাষ্যকে দিয়েছে অনিবার্যতা।তাঁর কবিতার বইয়ের শিরোনামগুলিও যেমন ছন্দোময় তেমনি দিকনির্দেশকারী। এই যূথবদ্ধতা বিরল প্রতিভা ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।এই অপার সৌন্দর্য ভরা পৃথিবীর মাঝখান থেকে তিনি তুলে এনেছেন সুরের স্বরলিপি।যা মানুষকে শুধু আনন্দই দেয় না, এক গভীর স্নিগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে রাখে আজীবন যা দেয় আরোগ্যও।তাই অলোকরঞ্জনের কবিতা আমাদের কাছে শুধু পাঠ্যবস্তু-ই নয় উপাসনারও বিকল্প।

খুব অনায়াসে ভোরের সজল ঘাসে
আলপনা এঁকে বস্তিপাড়ায় গিয়ে
অপেক্ষাকৃত দৃপ্ত সাক্ষরতা
জ্বেলে দিয়ে তার রুগ্ন প্রেমিকটিকে
চুম্বন দিয়ে বিজন সেতুর দিকে
হেঁটে গেল যেই পথের দুপাশে যত
খঞ্জ এবং যৌনকর্মিনীরা
জ্ঞাপন করল সান্দ্র কৃতজ্ঞতা।
(মেয়েটি/সে কি খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা/2012)

তাঁর কবিতার প্রতিপাদ্য হলো এক গভীর বিস্ময়।যা উপলব্ধি করা যায়।এক দীর্ঘ কাব্যিক পথে তিনি এই বিস্ময়ের ছাপ বারবার রেখেছেন।তার সঙ্গে রেখেছেন স্বদেশের ঐতিহ্যের গভীর অনুধ্যান যা ক্রমে ক্রমে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে ।পরবর্তী সময়ে তিনি বেদনালাঞ্ছিত এই পৃথিবীর এক অনিবার্য শুশ্রূষার অনুসন্ধানী হয়ে ওঠেন।তাঁর সমস্ত ক্ষোভ ও শোক তিনি ধারণ করে রাখেন স্নায়ুতন্ত্রীতে।বসনিয়ায় ন্যাটোর বোমাবর্ষণে একটি কিশোরীর মৃত্যুর প্রতিবাদে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় তোলার পক্ষে সওয়াল করেন।

অলোকরঞ্জনের কবিতায় রয়েছে এক কুহকের সঞ্চার।তাই তাঁর কবিতার সরলতা অন্যরকম ।ভাষার মধ্যে তাকে লক্ষ্য করা না গেলেও এক আচ্ছন্নতার ভিতর তাকে উপলব্ধি করা যায়।কিন্তু এটুকুই সব নয়।তার সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালে প্রবাহিত হয় এই সুবিশাল ভারত ভূখণ্ডের দিনরাত্রিগুলি ।

ট্রেন থামল সাহেবগঞ্জে, দাঁড়াল ডান পায়ে।
ট্রেন চলল ।থার্ড ক্লাসের মৃন্ময় কামরায়
দেহাতি সাতজন
একটি ঘুমে স্তব্ধ অসাড় নকশার মতন ;
এ ওর কাঁধে হাত রেখেছে, এ ওর আদুল গায়ে ;
সমবেত একটি ঘুমের কমনীয়তার
গড়েছে এক বৃত্তরেখা, দিগ্বধূর স্তন ;
পোড়ামাটির উপর দিয়ে আকাশে রথ যায় ।
(একটি ঘুমের টেরাকোটা/নিষিদ্ধ কোজাগরী/1967)

নিরীহ দৃষ্টিতে এ এক ট্রেনে চলমান কিছু দেহাতি মানুষের অকপট চিত্রকল্প।কিন্তু ঐ দেহাতি মানুষের আশ্চর্য বেঁচে থাকা কি আমার ভারতবর্ষ নয়? ভারতবর্ষের আবহমানকাল কি এসে নিঃশব্দে হাত রাখছে না তাদের আদুল গায়ের উপর? এলোমেলো ঘুমন্ত মানুষের অসাড় দেহের যে স্তব্ধ নকশা তা এক প্রাচীন সভ্যতার সংকেত বহন করছে।তিনি এই বিশাল ব্যাপৃত ভূখণ্ডকে ও তার সময়কে ধরতে চেয়েছেন এভাবেই যা তাঁর নিজস্ব উচ্চারণ।

আবার তিনি তো বিশ্বনাগরিক।তাই তাঁর কবিতা আশ্চর্য রকমভাবে আবহমানের।তবু আমরা কি বিস্ময়াবিষ্ট হই না যখন দেখি তাঁর কবিতায় সমকাল কত নিপুণভাবে ছবি এঁকে যায় !

একদিকে এই
দেশের যত শুভার্থী আর
অন্যদিকে আলজেরিয়ার মৌলবাদী
পাণ্ডারা সব
গায়েব করে দিল আমার
নতুন বোনকে।
(যমদুয়ারে/অস্তসূর্য এঁকে দিল টেম্পেরা/1997)

তবুও আমরা দেখেছি তিনি ভীষণ রকমের আন্তর্জাতিক হয়েও প্রবলভাবে স্বদেশী।বাংলা ভাষার গভীরে তাঁর চেতনার শেকড় গ্রথিত হয়ে আছে।এর একটা কারণ হতে পারে তাঁর চেতনার বোধিকেন্দ্রে রয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।তাই হয়ত তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম “নিজস্ব এই মাতৃভাষায়”(1990)।আর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম “এক একটি উপভাষায় বৃষ্টি পড়ে (1995)। সেইসব উপভাষায় কি বাংলা ভাষার আলো ছড়িয়ে নেই? তাহলে সেই মেঘপুঞ্জ তো আমাদেরই অস্তিত্বের নির্ণায়ক।তিনি বলছেন :”আমি বরং নিজেকে বিশ্ব-গ্রামীণ বলব”।

কবি যেন এক চৈতন্যসাগরে ভাসমান থেকে গেলেন আজীবন।এই নশ্বর জীবনকে সার্থকভাবে উপলব্ধি করতে তিনি এক জ্যোতির্ময় সত্তাকে স্পর্শ করতে চান অন্তরের নিভৃত প্রদেশ থেকে।

ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হল
সাঁইত্রিশ বছর পরে, তাঁর
বেশ ঝরে গেছে প্রোফাইল,
শুধু কিছু আকাশের নীল
ছুঁয়ে আছে মুখের বিষুব ।
(ইমেজ/ওষ্ঠে ভাসে প্রহৃত চুম্বন /2006)

কী গভীর এক নৈঃশব্দ্য মিশে আছে কবিতাটির গভীরে যখন উল্লিখিত অংশের শেষ দুটি লাইন উচ্চারিত হয়।আকাশের নীলে মাখামাখি হয়ে কী বিহ্বল হয়ে আছে ঈশ্বরের মুখ! তখন ঈশ্বরকেও কতটা অসহায় বলে মনে হয় । আমরা যেন নিজেকে কিছুটা চিনতে পারি সেই মুহূর্তে। আমাদের জীবনের বেদনালাঞ্ছিত মুহূর্তগুলো তখন কি জেগে উঠে কথা বলে না?সমগ্র ভৌগলিক ভূখণ্ড তখন এক জাগতিক আধ্যাত্মিকতায় ভরে ওঠে। আমাদের জীবনের বলয় ঘিরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আলো পড়ে ক্রমান্বয়ে ।

তাঁর কবিতায় গল্পের একটা চল লক্ষ্য করা যায়।আমাদের গ্রাম -বাংলার চরিত্ররা তখন জীবন্ত হয়ে ওঠে।অলোকরঞ্জনের কবিতা তাদের কথ্য হয়ে যায়।যা কিছু সহজ,যা কিছু সাবলীল তিনি তাকে ছন্দের মালা পরিয়ে কবিতার বিস্তৃত ভূখণ্ডের দিকে প্রসারিত করেন অবলীলায়। আমরা সেখানে দেখতে পাই মানবতার এক ঘনীভূত স্বরূপ।তাঁর হাতে কত লৌকিক শব্দ কবিতার ডানা মেলে উড়ে যায় চিরন্তন বিশ্বাসের দিকে।

সঙ্কটমোচন মন্দিরে
এক ফাঁকে
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুনসান
যে-লোকটা পালিয়ে গেল তাকে
বিসমিল্লা খান
সানাইটা একপাশে সরিয়ে
‘শুয়ারকা বাচ্চা’ বলে ধমক লাগান

কস্মিনকালেও আমি শুনিনি এত মধুর গান!
(শুয়ারকা বাচ্চা/ওষ্ঠে ভাসে প্রহৃত চুম্বন)

এইসব সংবেদী রচনা আমাদের মরমে অন্তঃসলিলা প্রেম সঞ্চারের কাজটি নিভৃতে করে চলে।একটি কবিতার ভিতর তখন রচিত হয় আরো বহু স্তর।একটি নির্মাণের মধ্যে আরো আরো বিনির্মাণ আর স্তরান্তর।গীতি কবিতার ধারার সঙ্গে সঙ্গে এক অমেয় প্রজ্ঞা তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।তার সঙ্গে থাকে এক প্রশ্নাতুর মানুষের ক্রমবিবর্তন যা তাঁর কবিতার ভাষ্যকে চালিত করেছে মানবযাত্রার চিরন্তন পথে ।তাই তাঁর ঈশ্বর কোনও শূন্যতার নাগরিক নন।সেই ঈশ্বরের খোঁজ তিনি করেছেন পার্থিব জল,মাটি,অন্নের ভিতর।তাঁর ঈশ্বর তাই পুরোদস্তুর আন্তর্জাতিক, ভীষণ রকম মানবিক।আমরা দেখেছি যুদ্ধ আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কী ভীষণ রকম উদ্বেগ তাঁর।জীবন সায়াহ্নে এসে এই কুরুক্ষেত্র -পৃথিবীর প্রতি তাঁর বেদনামথিত হাহাকার আমরা শুনতে পাই।যেন মনে হয় আড়াই হাজার বছরের এক সুপ্রাচীন বোধিবৃক্ষের নিচে বসে তিনি তপস্যা করে এলেন।আর উচ্চারণ করলেন এক বিষাদলিপি।

আমারই বিরোধাভাস বেড়ে যায়? স্বজাতীয়তার
নাম নিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণ
সেরে এসে ওরা যেই বলে উঠল,’সিদ্ধার্থের মুখে
সুস্মিতি ফুটে উঠেছে’ তুমি তো করোনি তিরস্কার!
(বুদ্ধ পূর্ণিমার রাত্রে (দ্বিতীয় পর্যায়)/ধুলোমাখা ঈথারের জামা/1999)

রাজস্থানের পোখরানে ভারতের পরমাণু বোমার পরীক্ষাও কবির সংবেদী মনকে ভীষণ রকম নাড়া দিয়ে যায়।কারণ কবি জানেন অস্ত্রের উৎপাদন কখনো সভ্যতাকে মানবিক করে তুলতে পারে না।তাই এই পর্বের কবিতাগুলোতে তিনি মিশিয়ে দেন এক গভীর সংবেদ আর সুতীব্র অভিমান।

তাঁর বেড়ে ওঠার সমস্ত প্রবাহ জুড়ে লেগে আছে শান্তিনিকেতনের ধুলো।আদম প্রকাশিত তাঁর একটি গদ্যের বইও আছে এই প্রসঙ্গে।
পেয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেন, কৃষ্ণ কৃপালনী প্রমুখের অকৃত্রিম স্নেহ । এই অত্যুজ্জ্বল রবীন্দ্রবলয় তাঁকে এক আলোকসম্ভব বোধিপর্ণে পরিণত করেছে।তাই সমগ্র মনপ্রাণ রবীন্দ্রনাথে থেকেও তিনি নিজস্ব আলোকসঞ্চারী হতে পেরেছেন।এ শুধুমাত্র গৌরবের নয়, এ পথ সাধনারও।তাই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন।এ বীজমন্ত্র রবীন্দ্রনাথ প্রোথিত এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি শাশ্বত বিশ্বে অমৃতের পুত্রসম মানবজীবনের অভিকেন্দ্রে তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ধ্রুবপদ বেঁধে রেখেছেন।তাই তিনি সূর্যের উজ্জ্বলতায় আভূমি ডুবে থেকেও নিজস্ব আলো বিকিরণ করতে পেরেছেন। তিনি স্বয়ং নক্ষত্র, স্বকীয়।

ব্যাথায় শুকনো খোয়াইয়ের বুক চিরে
আলোর সোহাগে রাঙানদী জাগে। আমি তারে ডেকে বলি :
“কার পায়ে তুমি ছড়াবে জলাঞ্জলি?”
কিছুই বলে না, রাঙানদী যায় সূর্যের মন্দিরে,
অবাক তাকায় মেঘের পাহাড়তলি।
………

সে -কান্না তবু গান হয়ে ওঠে; গোধূলির সংলাপে
একলা খুশির পালক ছড়িয়ে কোপাইয়ের জল কাঁপে,
পাখি হয়ে যেন উড়ে যাবে সে-ও, আকাশকে ঘিরে ঘিরে
চামর দোলাবে, চারণ শোনাবে সূর্যের মন্দিরে।।
(গোধূলির শান্তিনিকেতন/যৌবনবাউল)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত শব্দের মায়াজালে বেঁধে রাখেন বেশকিছু ধ্রুবপদ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি কথাকে গোপন রেখে এক রহস্যময়তায় ডুবে যেতে চান। কিন্তু সেটুকুই সব দেখা নয়। তিনি অত্যন্ত সমাজ সচেতন একজন কবি।কিন্তু সেটাও আবার তাঁর কাছে মুখ্য নয়। কারণ কবিতার আছে এক আবহমানের চলাচল। তিনি সেই চলাচলকে স্পর্শ করে কখনো মুখর কখনো মৌন। ঈশ্বরচেতনা, নিসর্গের দ্যুতি আর অনশ্বর প্রেম তাঁর কবিতার ভারকেন্দ্রে বিরাজ করে। একদিকে মানুষের চিরন্তন জয়কাব্য আর অন্যদিকে বিপন্ন সময়ের গভীর অনুরণন তাঁর কবিতায় পাশাপাশি চলতে পারে। তাঁর শেষ বয়সের কাব্যগ্রন্থগুলির নামকরণ কী অসম্ভব তাৎপর্যবাহী। সমস্ত হৃদয় শুধু ভূকম্পপ্রবণ হয়ে আছে (2006), গোলাপ এখন রাজনৈতিক (2008), বয়সের ছাপ মুছে ফেলি বল্কলে (2010), প্রণীত অগ্নি কাকে বলে তুমি জানো? (2011) ইত্যাদি।

নারী যেমন বুক অথবা গ্রীবা তো নয়
বিবাহবার্ষিকী যেমন বিবাহ নয়
প্রেম যেরকম মুগ্ধ প্রেমের কবিতা নয়
দেশটা যেমন কখনো নয় মন্ত্রণালয়
ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাই এমন সময়
ভিক্ষুণী এক আমার দিকে মমতাময়
তাকিয়ে রয় সে যদি আজ আমাকে ছোঁয়
দেশটা কি উচ্ছন্নে যাবে পথের ধুলোয়?
(চলনবলন/দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে/1983)

কী অকপট এই উচ্চারণ। কত সাবলীলভাবে তিনি ভিন্নমাত্রার প্রেমিক তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। একদিকে যেমন শিল্পের ন্যূনতম শর্ত সত্যকে তুলে ধরেন তেমনি অন্যদিকে এক প্রচ্ছন্ন তিরস্কার সঞ্চারিত করেন প্রশ্নের আদলে। আবার পৌরাণিক বিশ্বাসের গভীরতায় তিনি আমাদের দেখিয়ে দেন মহৎ প্রেমের দীপ্তি। একটি স্বগত উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে জনপদ থেকে প্রান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে…

তারপর চলে যেতে যেতে
তাকাল বিষন্ন চোখে দরিদ্রধূসর ধানক্ষেতে
বৃষ্টির বাসনা যেন কৃষাণীর দুনয়নে কালো
বিপুল বিস্ময়ে শুধালাম :
‘বলে যাও কী নাম তোমার?’
আবার ভ্রূযুগে তার ভ্রূকুটির আগুন ঘনাল :
‘এ জন্মে জানি না – তবু আর জন্মে সুজাতা ছিলাম।’
(বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে/যৌবনবাউল)

দৈনিক স্টেটস্ ম্যান পত্রিকাকে 18/02/2007 তারিখে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন : “কবি গটফ্রিড বেন একসময় স্থির করেছিলেন যে পাঁচটি উৎকীর্ণ কবিতা লিখতে পারলে মানুষের আর কিছু করার থাকে না।আমার বিনীত বিবেচনায় হয়ত আমার মধ্য দিয়ে এরকম পাঁচটি কবিতা লেখা হয়ে আছে। কিন্তু আমার ধরনটা সিংহাবলোকনের মতো নয়। অর্থাৎ আমি আমার প্রণীত বইগুলির দিকে আর ফিরেও তাকাই না। বিধাতা যদি করুণা করেন আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কবিতা লিখে যাব।”

বাংলা কবিতার কাছে এতখানি দায়বদ্ধ ছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সেই প্রাক যৌবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি একমাত্র কবিতার কাছেই কেবল নতজানু ছিলেন। আজন্ম বাউল এই কবি প্রায় শেষদিন পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন। এত দীর্ঘ কবি জীবনের অধিকার অর্জন করা খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তার থেকেও আরো সৌভাগ্যের বিষয় হলো আমরা এক অসামান্য আলোর সহস্ররঞ্জিত ধারায় স্নাত হবার সুযোগ পেয়েছি। এখন সেই পরিব্রাজকের পরিক্রমা সম্পন্ন করতে পারলে পথে পথে মাধুকরীর আনন্দ পাওয়া যাবে।

গ্রন্থঋণ:
কবিতা সমগ্র (দে’জ সংস্করণ)
শ্রেষ্ঠ কবিতা (প্রমা)
শেষ কথা কে বলবে (পত্রলেখা)
যৌবনবাউল (প্রতিভাস সংস্করণ)
গদ্য সমগ্র (প্রতিভাস)
আমাদের শান্তিনিকেতন (আদম)
আদম পত্রিকা, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল এবং আনন্দবাজার পত্রিকা।

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started